সহযাত্রী
-বিশ্বদীপ মুখার্জী
নিউ দিল্লী থেকে বিকেল চারটে বেজে পঁচিশ মিনিটে ছাড়ে শেয়ালদা রাজধানী এক্সপ্রেস। সৌভিক যখন নিউ দিল্লী স্টেশন পৌঁছালো তখন বিকেল চারটে। এখনও হাতে অনেক সময় আছে। ফার্স্ট এ.সি.তে রিজার্ভেশন তার। নিজের কামরা খুঁজে তাতে উঠলো সৌভিক। যে কেবিনে সৌভিকের রিজার্ভেশন, সেটা দুজনের কেবিন। মানে সৌভিক ছাড়া আরও একজন আসবে এই কেবিনে। জিনিসপত্র বার্থের নীচে রেখে জানালার ধারে বসলো সৌভিক।
সৌভিকের বয়স তিরিশ বছর। দিল্লীতে বড় কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করে সে। বাড়ি নৈহাটিতে। কিছুদিন পর তার বিয়ে। রিয়া নামের মেয়েটির বাড়ি বর্ধমানে। রিয়াও কাজ করে এক কর্পোরেট সেক্টরে, কোলকাতায়। সৌভিকের বিয়ে রিয়ার সাথেই। বিয়ের পর দিল্লীতে গিয়ে কোনো এক কোম্পানীতে কাজ করবে রিয়া।
‘ঠক্-ঠক্।’ দরজায় কেউ টোকা মারলো।
দরজা খুলতেই সৌভিক দেখে, এক মাঝবয়সী লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে। কালো রঙের পোশাকের ভদ্রলোকটির বাঁ হাতে এক ট্রলি ব্যাগ। মাথার চুল ধপধপে সাদা, মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি-গোঁফ। সৌভিকের বুঝতে অসুবিধে হলো না যে সেই ভদ্রলোকই তার সহযাত্রী। দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে ভদ্রলোককে ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিলো সৌভিক। ভেতরে ঢুকে এক গাল হেসে সৌভিককে ভদ্রলোক শুদ্ধ বাংলা ভাষায় বললেন- ‘সহযাত্রী যদি বাঙালী হয়, তাহলে যাত্রার আনন্দই আলাদা।’
সৌভিকের আশ্চর্য হলো। ভদ্রলোক কী করে বুঝলেন যে সৌভিক বাঙালী? সৌভিক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ভদ্রলোকের দিকে। সৌভিককে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোক অট্টহাস্য করে বললেন- ‘আশ্চর্য হবেন না মশাই। কামরার বাইরে যে রিজার্ভেশন চার্ট লাগানো আছে তাতেই দেখলাম যে আপনার নাম সৌভিক সান্যাল। আসলে কি জানেন, এটা আমার অভ্যেস। যখনই ট্রেনে যাত্রা করি তখনই রিজার্ভেশন চার্ট দেখেনি। সহযাত্রী যদি বাঙালী পাই, তাহলে মনটা খুশিতে ভরে যায়। আমার নাম দেবব্রত ভট্টাচার্য।’
দেবব্রত করমর্দন করলেন সৌভিকের সাথে।
নির্ধারিত সময়ে নিউ দিল্লী থেকে রওনা দিলো শেয়ালদা রাজধানী এক্সপ্রেস। পরবর্তী স্টেশন কানপুর সেন্ট্রাল আসতে এখন বহু দেরি। ইতিমধ্যেই সৌভিক লক্ষ করেছে যে দেবব্রত ভট্টাচার্য কথা বলতে বেশ ভালোবাসেন। অনবরত কথা বলা তাঁর অভ্যেস হয়তো। তিনি বললেন- ‘আমার বাড়ি খড়্গপুরে। হাওড়া রাজধানীতে টিকিট পেলে ভালো হতো। হাওড়াতে নেমে লোকাল ধরে খড়্গপুর চলে যেতাম।’
গল্প করতে সৌভিকেরও যে খুব একটা মন্দ লাগে তা নয়। শেয়ালদা পৌঁছতে এখন অনেক দেরি। সেই পরের দিন সকাল দশটা দশ। যাত্রাপথ যদি গল্পে কেটে যায়, তাহলে বেশ ভালোই হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনের গল্প বেশ জমে উঠলো। দেবব্রত বাবু বললেন- ‘আসলে একটা ফোনের অপেক্ষা করছি আমি। যদি ফোনটা আসে তাহলে আমাকে আসানসোলে নামতে হবে। আর যদি ফোন না আসে তাহলে সোজা শেয়ালদা।’
‘সে কি? আপনি এখনও এটাই জানেন না যে আপনাকে নামতে কোথায় হবে?’ আবার আশ্চর্য হলো সৌভিকের। কেমন বিচিত্র লোক বাবা!
‘আসলে আমার এক বন্ধুর ছেলের রিসেপশন পার্টি সেখানে। নিমন্ত্রণ করেছিলো। আবদার ছিলো শো দেখবার। আজকাল শো আর বেশি দেখাই না। দেখি , যদি লাস্ট রিকোয়েস্ট সে করে তাহলে তো দেখাতেই হবে শো।’
‘কিসের শো?’ জিজ্ঞেস করলো সৌভিক।
খানিক বিরতি নিয়ে দেবব্রত বাবু বললেন– ‘ম্যাজিকের শো।’
গাজিয়াবাদ স্টেশন পেরিয়ে গেছে। দ্রুত গতিতে ছুটছে রাজধানী এক্সপ্রেস। ইতিমধ্যেই টি.টি. এসে টিকিট দেখে গেছে। বাটার টোস্ট এবং টমাটো সুপ দিয়ে গেছে প্যান্ট্রি থেকে। টমাটো সুপে একটা চুমুক দিয়ে সৌভিক জিজ্ঞেস করলো – ‘আপনি কি ম্যাজিশিয়ান?’
‘হ্যাঁ। আপনি জাদুকর পি এস ভট্টাচার্যর নাম শুনেছেন?’
নিজের বাবা ও ঠাকুরদার মুখে জাদুকর পি এস ভট্টাচার্যর নাম সৌভিক শুনেছে। জাদুকর হিসেবে বেশ নামডাক ছিলো তাঁর। সৌভিক মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।
‘সেই বিখ্যাত জাদুকর পি এস ভট্টাচার্যর একমাত্র ছেলে আমি।’ মৃদু হেসে দেবব্রত বাবু বললেন।
‘সে কি! আপনি সেই বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান পার্থ সারথি ভট্টাচার্যর ছেলে?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। কিছুটা বাবার কাছ থেকে শিখেছি , কিছুটা শিখেছি বিদেশের কিছু জাদুকরের সান্নিধ্য পেয়ে।’
সৌভিক বর্তমান যুগের ছেলে। বিজ্ঞানে বিশ্বাসী। সব কিছুতেই বৈজ্ঞানিক যুক্তি দেওয়া তার অভ্যেস। অন্যদের মতো সেও জাদুটাকে কিছুটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও কিছুটা হাতের সাফাই বলে মনে করে।
‘ম্যাজিকে হিপ্নোটিজমটা বেশ ভালো, বাকি সব তো বেকার।’ নিজের খাবার শেষ করে সৌভিক বলল- ‘হাতের সাফাইটাই হলো আসল। যে যত ভালো হাতের সাফাই পারবে, আজকের দিনে সে ততো ভালো ম্যাজিশিয়ান। হ্যাঁ, সাথে অল্পবিস্তর বিজ্ঞানও থাকে অবশ্য।’
সৌভিকের দিকে তাকিয়ে অল্প হাসলেন দেবব্রত। বললেন – ‘বর্তমান যুগে লোকেরা তাই মনে করে বটে। কিন্তু ম্যাজিক বিজ্ঞান ও হাত কী সাফাই থেকে ঊর্ধে।’
‘সেটা আপনার মনে হতে পারে, দেবব্রত বাবু। কেন কি আপনি ম্যাজিক দেখান। ক্ষমা করবেন, আপনার প্রফেশনকে ছোট করা আমার উদ্দেশ্য নয়। যেটা সত্য সেটাই বলছি। হিপ্নোটিজ্ম দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু দেখতে গেলে সেটাও তো সাইন্স। ভালো ভালো মনোচিকিৎসকেরাও হিপ্নোটিজ্ম পারে।’
‘অবশ্যই পারে। কিছু কিছু ম্যাজিকে বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে সেটা ঠিক, কিন্তু সব ম্যাজিক বিজ্ঞান ও হাত কী সাফাই নয় সান্যাল বাবু।’
বেশি তর্কবিতর্কে যাওয়া স্বভাব নয় সৌভিকের। শুধু বলল- ‘এই যাত্রাপথে কোনো ম্যাজিক দেখাবেন কি? তাহলে সময়টা মন্দ কাটবে না।’
দেবব্রতবাবু উত্তর না দিয়ে সৌভিকের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
রাত সাড়ে ন’টায় যখন ট্রেন কানপুর সেন্ট্রাল থেকে রওনা দিলো, তখন দুজনেরই রাত্রি আহার শেষ হয় গেছে। দেবব্রত বাবুর সাথে কথা হওয়ার পর ক্রমাগত রিয়ার সাথে ফোনে কথা বলে গেলো সৌভিক। সেই কথা বিরাম পেলো রাত্রি আহারের পূর্বে। ডিনার শেষ হওয়ার পর এবার শুতে যাওয়ার পালা। সৌভিকের বার্থ নীচে এবং দেবব্রত বাবুর ওপরে। শুতে যাওয়ার আগে সৌভিক দেবব্রতবাবুকে বলল- ‘ম্যাজিক দেখা আর হলো না।’
মুচকি হেসে দেবব্রত বাবু বললেন- ‘ভবিষ্যতে আবার যদি দেখা হয়, তাহলে অবশ্যই দেখবো ম্যাজিক।’
তখন প্রায় রাত দুটো। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল সৌভিকের। ব্যাপারটা কী? ট্রেনটা আজ একটু বেশি জোরে চলছে বলে মনে হচ্ছে না? ট্রেন চলার শব্দ একটু বেশিই কানে লাগছে এবং দুলুনিটাও অনেকটা বেশি। রাজধানী এক্সপ্রেসে এই প্রথম যাত্রা করছে না সৌভিক। কোনো বার তো এমন মনে হয়নি। তাহলে আজ হঠাৎ….
কেবিনটা প্রায় অন্ধকার। একটা ছোট্ট নীল রঙ্গের বেড লাইট কেবিনকে আলোকিত করে রেখেছে। কেবিনের একই ধারে ওপর নীচে করে দুটো বার্থ। বার্থের ঠিক উল্টো দিকে প্লাইএর দেয়াল। দেয়ালে আয়না ঝুলছে এবং জামাকাপড় রাখার ছোট একটা তাক সেখানে। সেই প্লাইএর দেয়ালের কাছেই দেবব্রত বাবুর ট্রলি ব্যাগ রাখা ছিলো। আলোআঁধারির মধ্যে সৌভিক দেখতে পেলো দেবব্রতবাবুর সেই ট্রলিটা নেই। চমকে উঠল সৌভিক। ট্রলিটা গেলো কোথায়। ঘুমের ঘোরে সে ভুল দেখছে না তো? আরও ভালো করে দেখবার চেষ্টা করলো সে। না, সে কিছু ভুল দেখছে না। উঠে দাঁড়ালো সৌভিক। ওপরের বার্থের দিকে তাকাতেই আশ্চর্যের সীমা থাকলো না তার। দেবব্রত ভট্টাচার্য তো কম্বল ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। এতো রাতে হঠাৎ নিজের ট্রলি ব্যাগ নিয়ে গেলেন কোথায়? তিনি বলেছিলেন যে তাঁকে আসানসোলেও নামতে হতে পারে। কিন্তু আসানসোল আসতে তো এখনও বহু দেরি। কী একটা মনে হতে বার্থের নীচে রাখা নিজের জিনিসপত্রগুলোকে দেখে নিলো সৌভিক। সেগুলো যথাস্থানেই আছে। নিজের মোবাইলে আগেই সময় দেখে নিয়েছিল সৌভিক। রাত দুটো দশ। এতো রাতে হঠাৎ দেবব্রত বাবু গেলেন কোথায়? প্রশ্নটা বারবার তার মনকে নাড়া দিতে লাগলো। কৌতূহল আর সন্দেহ মেশানো অনুভূতি নিয়ে কেবিনের বাইরে বেরোতে গেলো সৌভিক। কেবিনের দরজাটা খোলার সময় তার শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেলো এক ঠান্ডা স্রোত। তাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের কারণে কেবিনটা বেশ ঠান্ডা হয় গিয়েছিল। কিন্তু এই ঠান্ডা পরিবেশেও দরদর করে ঘেমে গেলো সৌভিক। কেবিনের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজার কাছে খানিক মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল সৌভিক। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ অথচ দেবব্রতবাবু কেবিনে নেই। কিছুক্ষণের জন্য তো কিছুই বুঝতে পেলো না সৌভিক। সে কী ভয় পেলো? কিন্তু ভয় পাওয়া তো তার স্বভাব বিরুদ্ধে। ছোট থেকেই সে শুনে এসেছে যে, সৌভিক সাহসী। ভয় তার ধারেকাছে আসতে পারে না। সেই সাহসের আজ কী হলো? না, সৌভিক ভীতু নয়। সাহস তাকে দেখতেই হবে। এই অদ্ভুত রহস্যের সমাধান তাকে করতেই হবে।
কেবিনের দরজা খুলে বাইরে বেরলো সৌভিক। ট্রেন চলার শব্দ আরও বিকট ভাবে তার কানে এলো। লম্বা করিডোর। বেশ কিছু আলো জ্বলছে সেখানে। ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের দু’দিকে একবার তাকিয়ে নিলো সৌভিক। কোথাও কোনো জনপ্রাণী নেই। সৌভিক নিজের ডান দিকে এগোলো। করিডোরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে বাথরুমের দিকে গেলো সৌভিক। দু’টো বাথরুমই খোলা , তাতে কেউ নেই। নিজের মনের জোরে যে ভয়টাকে সৌভিক দাবিয়ে রেখেছিল, সেটা ক্রমে বাড়তে শুরু করলো। বন্ধ একটা ঘর থেকে এক জন উধাও হয় কী করে, এই প্রশ্নটা তাকে বিচলিত করে তুলছিল বারবার। রুদ্ধশ্বাসে সৌভিক দৌড়ে গেলো করিডোরের আরেক প্রান্তে। কামরার দরজার কাছে উল্টো দিকে মুখ করে একজনকে শুয়ে থাকতে দেখলো সে। পরনে সাদা জামা ও সাদা প্যান্ট। সৌভিক বুঝতে সময় নিলো না যে শুয়ে থাকা ভদ্রলোকটি কোচ অ্যাটেনডেন্ট।
‘দাদা , ও দাদা!’
কোচ অ্যাটেনডেন্টকে ডাকলো সৌভিক। কোনো সাড়া শব্দ নেই। দু’তিন বার আরও ডাকলো সে। দেবব্রতবাবু যদি কোথাও গিয়েও থাকেন তাহলে কোচ অ্যাটেনডেন্ট সেটা জানবে। তাই তাকে ঘুম থেকে ওঠানো দরকার। ঘুমন্ত ব্যক্তিটির কাঁধে হাত দিয়ে দু’বার ধাক্কা দিলো সৌভিক। কোচ অ্যাটেনডেন্ট ধড়ফড় করে উঠে পড়লো। সৌভিকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো– ‘কেয়া হুয়া বাবু?’
কোচ অ্যাটেনডেন্টকে দেখে সৌভিক চার হাত পেছনে ছিটকে গেলো। বিস্ফোরিত নেত্রে চেয়ে রইল তার দিক। এ তো কোচ অ্যাটেনডেন্ট নয়। এ তো অবিকল দেবব্রত ভট্টাচার্য। সেই ধপধপে সাদা চুল, মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি গোঁফ। কন্ঠস্বরও তো একই। ভয় যেন রক্ত শূন্য সৌভিক। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। ঠিক মনে হচ্ছে দেবব্রত বাবু নিজের পরিধান পরিবর্তন করে সৌভিকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
‘কেয়া হুয়া বাবু?’ কোচ অ্যাটেনডেন্ট সৌভিকের দিকে এগিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
সে মুহূর্তে সৌভিকের চিন্তাশক্তি যেন লোপ পেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কিছুই না বুঝতে পেয়ে দৌড় দিলো নিজের কেবিনের দিকে।
‘কেয়া হুয়া বাবু? কেয়া হুয়া বাবু?’ জিজ্ঞেস করতে করতে কোচ অ্যাটেনডেন্টও তার পিছু নিলো। নিজের কাবিনের কাছে পৌঁছে ভয় আতঙ্কে মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা হলো সৌভিকের। তার পরিস্কার মনে আছে কেবিনের দরজা খুলেই সে বাইরে বেরিয়েছিল। এখন সে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
‘দরজা খোলো, দরজা খোলো, প্লিজ দরজাটা খোলো।’ পাগলের মতো দরজা পেটাচ্ছে ও চিৎকার করছে সৌভিক। কিন্তু দরজা খুলছে না কেউ। সৌভিক নিজের ডান দিকে তাকালো। কোচ অ্যাটেনডেন্ট ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে তার দিকে। তার মুখে রহস্যময় হাসি। সৌভিক আবার দরজায় ধাক্কা দিলো। সৌভিকের প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। যে সময় কোচ অ্যাটেনডেন্ট তার থেকে মাত্র দু’ হাত দূরে , ঠিক সেই মূহুর্তর কেবিনের দরজা খুলে গেলো। কেউ সৌভিকের হাত ধরে টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে তার বার্থে তাকে বসিয়ে দিলো। সৌভিক দেখলো তার সামনে দেবব্রত ভট্টাচার্য। সেইকালো রঙের বস্ত্রে।
‘কী হলো? এতো ভয় পাচ্ছেন কেন আপনি?’ দেবব্রত বাবু মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন সৌভিককে।
আর তখনই সৌভিক দেখলো কেবিনে প্রবেশ করলো সেই কোচ অ্যাটেনডেন্ট। অবিকল দেবব্রত ভট্টাচার্য। দুই দেবব্রত ভট্টাচার্য মিলে অট্টহাস্য শুরু করলো সৌভিকের অবস্থা দেখে। সৌভিক বার্থে বসে কিছুক্ষণ দেখলো তাদের। দৃষ্টি আসতে আসতে ঝাপসা হলো , তার পর চোখের সামনে অন্ধকার।
যখন ঘুম ভাঙ্গলো সৌভিকের তখন সকাল প্রায় আটটা। রাজধানী এক্সপ্রেস তখন বর্ধমানের কাছে। ঘুম ভাঙতেই রাতের ঘটনাগুলো সৌভিকের চোখের সামনে একে একে ভেসে এলো। কী অদ্ভুত ও বীভৎস রহস্য! রাতের কিছু দৃশ্য ও সকালের কিছু দৃশ্যতে সামঞ্জস্য পেলো সৌভিক। দেবব্রত ভট্টাচার্য নেই, নেই তার ট্রলি ব্যাগটাও। সৌভিক কিছুই বুঝতে পারছিল না তার সাথে এটা হচ্ছেটা কী? তার মন থেকে আতঙ্কের কালো ছায়া এখনও কাটেনি। কেবিনের দরজা খুলে বাইরে বেরোতে গিয়ে দেখলো দরজা খোলা। বাইরে বেরোলো সে। অন্য এক কেবিন থেকে কোচ অ্যাটেনডেন্ট বেরিয়ে তার দিকেই আসছিল। সৌভিক তাকে ভালো করে দেখলো। না, এর চেহারার সাথে কোনো মিল নেই দেবব্রত বাবুর।
‘আমার কেবিনের এক জন আরও ছিলেন। তিনি কোথায় গেলেন আপনি বলতে পারবেন কি?’ কোচ অ্যাটেনডেন্টকে জিজ্ঞেস করলো সৌভিক।
‘উনি তো আসানসোল নেমে গেলেন।’ জবাব দিয়ে কোচ অ্যাটেনডেন্ট এগিয়ে গেলো।
সৌভিক নিজের কেবিনে ফিরে এলো। জানালার কাছের ডেস্কে এক চার ফালি করে মোড়া কাগজের টুকরো দেখতে পেলো সে। কাগজ উঠিয়ে দেখলো সৌভিক। একটা চিঠি।
” সৌভিক বাবু ,
দু’টো কারণে আপনার থেকে ক্ষমা চাইছি। প্রথমত, আপনাকে না বলে চললাম। দেখলাম আপনি গভীর ঘুমে মগ্ন। তাই বিরক্ত করা ঠিক মনে হলো না। আমাকে আসানসোল নামতে হলো। কাল রাতে বন্ধুর ফোন এসেছিল। ক্ষমা চাইবার দ্বিতীয় কারণ হলো, গত রাত্রে আপনাকে ভয় দেখানো। আপনি বলেছিলেন যে ম্যাজিক বিজ্ঞান ও হাত কী সাফাই ভিন্ন কিছুই না। আমার কথা আপনি বিশ্বাস করেননি। গত রাতে যা হলো সেটা না তো বিজ্ঞান ছিলো, আর না হাতের সাফাই। কারুর স্বপ্নে ঢুকে ভয় দেখানোটাও একটা ম্যাজিক। প্রকৃত ম্যাজিক বিজ্ঞান ও হাত কী সাফাই থেকে ঊর্ধে। আবারও ক্ষমা চাইছি আপনার থেকে। দুনিয়াটা গোল। ভবিষ্যতে কোথাও না কোথাও আবার দেখা হবে। চললাম।
আপনার সহযাত্রী
দেবব্রত ভট্টাচার্য
চিঠিটা নিজের জামার পকেটে রেখে জানালার দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো সৌভিক।